বিশ্বমানের ফেডারেশন চেম্বার গঠনের রূপরেখা
মো: জয়নাল আব্দীন
প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ট্রেড এণ্ড ইনভেস্টমেন্ট বাংলাদেশ (টিএণ্ডআইবি)
নির্বাহী পরিচালক, অনলাইন ট্রেনিং একাডেমী (ওটিএ) এবং
মহাসচিব, ব্রাজিল বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এণ্ড ইন্ডাস্ট্রি (বিবিসিসিআই)
বাংলাদেশের বাণিজ্য–বিনিয়োগ প্রেক্ষাপটে এফবিসিসিআই দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি খাতের প্ল্যাটফর্ম—যা ৪০৯টি ট্রেড/সেক্টর অ্যাসোসিয়েশন, ৮৭টি জেলা চেম্বার ও ২০টি জয়েন্ট চেম্বারকে প্রতিনিধিত্ব করে নীতি–সহায়তা, সক্ষমতা উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কিং ও বিরোধ নিষ্পত্তিতে সেতুবন্ধন করে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ৪৮.২৮ বিলিয়ন ডলার; এর মধ্যে তৈরি পোশাক খাত একাই ৩৯.৩৫ বিলিয়ন ডলার আয় করে মোট রপ্তানির ৮১%-এর বেশি অংশ দখল করেছে অর্থাৎ রপ্তানির নির্ভরতা এখনও খুবই উচ্চ, বৈচিত্র্য সীমিত।
একই সময়ে ক্ষুদ্র-কুটির-মাইক্রো-ক্ষুদ্র-মাঝারি (CMSME) খাত দেশের শিল্পস্থাপনার ৯৯.৯% এবং ২ কোটির বেশি কর্মসংস্থান বহন করলেও জিডিপিতে তাদের অবদান দীর্ঘদিন ২১–২২% সীমায় আটকে আছে; ফলে উৎপাদনশীলতা, প্রযুক্তি ও বাজারে প্রবেশাধিকার জোরদারে সমন্বিত সহায়তা জরুরি। এদিকে নেট এফডিআই ২০২৪ সালে কমে প্রায় ১.২৭ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে যা অর্থায়ন, প্রযুক্তি ও গ্লোবাল ভ্যালু চেইনে গভীরতর সংযুক্তির জন্য অপ্রতুল সংকেত। এই প্রেক্ষাপটে এফবিসিসিআই-এর নীতি সংলাপ, ট্রেড-ফ্যাসিলিটেশন ও বিনিয়োগ আহ্বানের ভূমিকা আরও কৌশলগত ও তথ্যনির্ভর হওয়াই সময়ের দাবি।
কেন “বিশ্বমানের ফেডারেশন চেম্বার” এখন জরুরি—তার প্রধান কারণগুলো হলো: (১) রপ্তানি অতিমাত্রায় পোশাকনির্ভর; ফলে বাজার-পণ্য বৈচিত্র্য, সাপ্লাই চেইন রেজিলিয়েন্স ও নতুন খাতে (আইসিটি, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং, ফার্মা, এগ্রো-প্রসেসিং, ব্লু-ইকোনমি) স্কেল-আপ দরকার; (২) কম নেট এফডিআই ও এসএমই-কেন্দ্রিক উৎপাদনশীলতা গ্যাপ যা করপোরেট গভর্ন্যান্স, মান-অনুবর্তিতা (ESG), এবং ক্রেডিট-লিংকড সাপোর্ট ছাড়া কাটানো কঠিন; (৩) ডিজিটাল ট্রেড, মান সনদ, শুল্ক-অশুল্ক বাধা ও সবুজ সমন্বয় (CBAM-ধরনের নিয়ম) সামাল দিতে ডেটা-হাব, দ্রুত নীতিপ্রস্তাব, আরবিট্রেশন/মেডিয়েশন সেল, “ওয়ান-স্টপ” ট্রেড-ফ্যাসিলিটেশন ডেস্ক ও গ্লোবাল চেম্বার নেটওয়ার্কে সক্রিয় জোটসঙ্গী হওয়া। তাই বিশ্বমানের এফবিসিসিআই মানে থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক শক্তি, প্রমাণভিত্তিক অ্যাডভোকেসি, সেক্টর-স্টেট কাউন্সিলের ড্যাশবোর্ড, এক্সপোর্ট-রেডি ৫০০ এসএমই পাইপলাইন, এবং বিনিয়োগ-আকর্ষণ মিশনকে (ডায়াসপোরা/অ্যাঙ্কর-ইনভেস্টর টার্গেটিং) বছরের ক্যালেন্ডারে বাঁধা যাতে রপ্তানির নির্ভরতা কমে, নতুন বাজার-পণ্য যোগ হয়, আর এফডিআই/প্রযুক্তি প্রবাহ ত্বরান্বিত হয়। (প্রমাণ: FY25-এ মোট রপ্তানি ও RMG-এর শেয়ার; CMSME-র আকার-অবদান; নেট এফডিআই কমে যাওয়ার প্রবণতা)।
১. বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চেম্বারের রূপান্তর
১.১ উন্নত দেশের ফেডারেশন চেম্বারগুলোর অভিজ্ঞতা
উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোতে ফেডারেশন চেম্বারগুলো শুধু ব্যবসায়ীদের সংগঠন নয়, বরং জাতীয় নীতি প্রণয়ন ও আন্তর্জাতিক ট্রেড নেগোসিয়েশনের মূল সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। যেমন, FICCI (India) শতবর্ষী ঐতিহ্যের পাশাপাশি নিয়মিত policy paper, সেক্টরভিত্তিক task force ও আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে সরকারকে পরামর্শ দেয় এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে দেশীয় উদ্যোক্তাদের যুক্ত করে। TOBB (Turkey) ডিজিটাল রেজিস্ট্রি সিস্টেম, SME ক্লাস্টারিং এবং ট্রান্সপোর্ট–লজিস্টিক্স হাব উন্নয়নের মাধ্যমে ব্যবসায়িক পরিবেশকে প্রযুক্তিনির্ভর করেছে। অন্যদিকে, Apex-Brazil বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য মিশন, প্রদর্শনী এবং বিনিয়োগ প্রচারণার মাধ্যমে তাদের পণ্যকে ২০০টিরও বেশি বাজারে পৌঁছে দিয়েছে। এসব অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে, একটি আধুনিক ফেডারেশন চেম্বার শুধু সদস্যসেবা নয়, বরং গবেষণা, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং, ডিজিটাল ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন এবং রাষ্ট্রীয় কূটনীতির অংশীদার হয়ে ওঠে।
১.২ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যযুদ্ধ, সাপ্লাই চেইন পরিবর্তন ও রিজিওনাল ট্রেড ব্লক
গত এক দশকে যুক্তরাষ্ট্র–চীন বাণিজ্যযুদ্ধ, রাশিয়া–ইউক্রেন সংঘাত, এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের CBAM (Carbon Border Adjustment Mechanism)–এর মতো নতুন বাণিজ্য নীতির ফলে বৈশ্বিক বাজার ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠেছে। একদিকে চীনের সাপ্লাই চেইন ডমিনেন্স চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে, অন্যদিকে ভিয়েতনাম, মেক্সিকো, ভারত ইত্যাদি দেশ দ্রুত বিকল্প উৎপাদনকেন্দ্র হিসেবে উঠে আসছে। একইসঙ্গে RCEP (Regional Comprehensive Economic Partnership), AfCFTA, ও CPTPP–এর মতো আঞ্চলিক ট্রেড ব্লকগুলো নতুন গ্লোবাল ট্রেড আর্কিটেকচার তৈরি করছে। ফলে উৎপাদন ও বাজারে reshoring, friend-shoring এবং আঞ্চলিক একীভূতকরণের প্রবণতা জোরদার হয়েছে।
১.৩ বাংলাদেশের জন্য সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ
এই পরিবর্তনের মধ্যে বাংলাদেশ একদিকে সুযোগ পাচ্ছে, অন্যদিকে কঠিন চ্যালেঞ্জও মোকাবিলা করছে। সুযোগ হলো—চীন থেকে উৎপাদন স্থানান্তরের ঢেউ, যেখানে বাংলাদেশ কম খরচের শ্রম ও দ্রুত বর্ধনশীল অভ্যন্তরীণ বাজার দিয়ে নতুন বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারে। তাছাড়া, RCEP বা ভারত–ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আঞ্চলিক ভ্যালু চেইনে প্রবেশের পথও উন্মুক্ত হচ্ছে। তবে চ্যালেঞ্জও বড়—একদিকে অতিমাত্রায় তৈরি পোশাকনির্ভর রপ্তানি (৮০%+), অন্যদিকে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমে যাওয়া ও প্রযুক্তি–উদ্ভাবনে পিছিয়ে থাকা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সবুজ বাণিজ্য বাধা (ESG compliance, CBAM ইত্যাদি) ও আন্তর্জাতিক বাজারে মান–সনদ (ISO, HACCP, FDA) অর্জনের চাপ। এসব সুযোগ–চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে একটি বিশ্বমানের এফবিসিসিআই–এর প্রয়োজন, যা হবে নীতি–সহায়তা, গবেষণা–তথ্যভিত্তিক পরামর্শ, আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কিং এবং ট্রেড–ফ্যাসিলিটেশনের কেন্দ্রবিন্দু।
২. বিশ্বমানের চেম্বারের মৌলিক বৈশিষ্ট্য
২.১ নীতি প্রণয়নে সক্রিয় ভূমিকা
একটি বিশ্বমানের ফেডারেশন চেম্বারের প্রধান দায়িত্ব হলো সরকারের নীতি প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় কার্যকর অংশীদার হওয়া। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাজেট, ট্যাক্স, রপ্তানি–আমদানি নীতি, শিল্পনীতি, শ্রমনীতি প্রভৃতির ক্ষেত্রে এফবিসিসিআই যদি নিয়মিত policy brief, white paper ও regulatory impact assessment উপস্থাপন করে, তবে সরকারকে তথ্যনির্ভর সিদ্ধান্তে সহায়তা করা সহজ হবে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতের FICCI বা যুক্তরাজ্যের CBI নিয়মিতভাবে সংসদীয় কমিটিতে উপস্থাপনা করে থাকে। বাংলাদেশের এফবিসিসিআইও একইভাবে সংসদ, মন্ত্রণালয় ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে ধারাবাহিক আলোচনার মাধ্যমে ব্যবসায়ী সমাজের মতামতকে নীতির মূলধারায় আনার ক্ষমতা অর্জন করতে পারে।
২.২ গবেষণা ও থিঙ্ক-ট্যাঙ্ক সক্ষমতা
বিশ্বমানের চেম্বারগুলো শুধু মতামত দেয় না, বরং প্রমাণ–ভিত্তিক গবেষণা করে। বাংলাদেশের এফবিসিসিআইকে থিঙ্ক–ট্যাঙ্কে রূপান্তর করতে হলে অর্থনীতি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, এসএমই, কৃষি, শিল্পায়ন, পরিবেশ–সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে বিশেষায়িত গবেষণা ইউনিট গড়ে তুলতে হবে। এতে করে ব্যবসায়ী সমাজ সরকারকে শুধু সমস্যা নয়, বরং সমাধানসহকারে প্রস্তাব দিতে পারবে। উদাহরণ হিসেবে Apex-Brazil নিয়মিত sectoral reports ও global market intelligence প্রকাশ করে যা উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ ও রপ্তানি সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও রপ্তানি বাজার বৈচিত্র্যকরণ, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ এবং প্রযুক্তি স্থানান্তর নিয়ে গবেষণা প্রয়োজন।
২.৩ প্রযুক্তি ও তথ্য-উপাত্তভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ
আজকের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে ডেটা–ড্রিভেন ডিসিশন মেকিং ছাড়া কার্যকর চেম্বার কল্পনা করা যায় না। একটি আধুনিক এফবিসিসিআইয়ের থাকা উচিত real-time trade database, investment tracker, sectoral dashboard এবং policy simulation tools। উদাহরণস্বরূপ, তুরস্কের TOBB ডিজিটাল কোম্পানি রেজিস্ট্রি ও রপ্তানি–আমদানি ডাটাবেসের মাধ্যমে সদস্যদের দ্রুত সেবা প্রদান করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তথ্য বিনিময়, কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সে সহায়তা, আন্তর্জাতিক সনদপত্রের (ISO, HACCP) তথ্যপ্রবাহ ও বিনিয়োগ প্রবণতার ডেটা ট্র্যাকিং জরুরি।
২.৪ সদস্যসেবা ও নেটওয়ার্ক বিস্তারের মানদণ্ড
বিশ্বমানের ফেডারেশন চেম্বারকে তার সদস্যদের জন্য সুনির্দিষ্ট ও মূল্যবান সেবা নিশ্চিত করতে হবে। যেমন—ট্রেনিং ও সক্ষমতা উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ, বিদেশি ডেলিগেশন ম্যানেজমেন্ট, আইনি সহায়তা ও বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তি। একইসঙ্গে গ্লোবাল চেম্বার নেটওয়ার্ক (ICC, WCF, RCEP-Business Council, ইত্যাদি)-এ সক্রিয় উপস্থিতি বজায় রাখতে হবে। এর মাধ্যমে সদস্যরা সরাসরি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশাধিকার, নতুন ক্রেতা–সরবরাহকারীর সঙ্গে সম্পর্ক ও বৈদেশিক বিনিয়োগকারীর সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারবেন। মানদণ্ড হবে—সদস্য সন্তুষ্টি, বৈশ্বিক নেটওয়ার্কে দৃশ্যমানতা এবং সরাসরি ব্যবসায়িক সুফল।
৩. প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও সাংগঠনিক কাঠামো
৩.১ স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন
একটি বিশ্বমানের ফেডারেশন চেম্বারের জন্য স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা অপরিহার্য। বাজেট প্রণয়ন থেকে শুরু করে প্রকল্প বাস্তবায়ন, আন্তর্জাতিক ভ্রমণ, এবং দাতাদের অর্থ ব্যবহার—সবকিছুতে উন্মুক্ত আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে। বার্ষিক অডিট রিপোর্ট, অনলাইন ড্যাশবোর্ডে আয়ের-ব্যয়ের বিবরণ, এবং সদস্যদের জন্য নিয়মিত জবাবদিহিমূলক সভা আয়োজন করলে আস্থা তৈরি হবে। আন্তর্জাতিকভাবে ICC বা Eurochambres–এর মতো সংগঠনগুলো স্বচ্ছতার মানদণ্ড বজায় রাখে, যা সদস্য ও সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্যতা বাড়ায়।
৩.২ পেশাদার সচিবালয় ও আধুনিক প্রশাসনিক কাঠামো
বর্তমানে এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসনিক কাজ অনেকাংশে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু বিশ্বমানের চেম্বারে থাকে পেশাদার সচিবালয়, যেখানে দক্ষ অর্থনীতিবিদ, গবেষক, আইনজীবী, ডিজিটাল সল্যুশন বিশেষজ্ঞ, এবং ইভেন্ট ম্যানেজারদের টিম কাজ করে। তাদের কাজ হবে নীতি প্রস্তাবনা তৈরি, গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ, আন্তর্জাতিক ডেলিগেশন পরিচালনা এবং সদস্যসেবা নিশ্চিত করা। একটি ক্যারিয়ার সিভিল সার্ভিস মডেল–এর মতো স্থায়ী কাঠামো থাকলে ধারাবাহিকতা ও পেশাদারিত্ব বজায় থাকে।
৩.৩ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার আধুনিকায়ন
এফবিসিসিআই নির্বাচন প্রায়শই ব্যবসায়ী সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে। তাই দরকার ডিজিটাল ভোটিং সিস্টেম, বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন ও অনলাইন সদস্য ডাটাবেস–এর মতো আধুনিক ব্যবস্থা। এতে অনিয়ম ও দ্বন্দ্ব কমবে, অংশগ্রহণ বাড়বে এবং সদস্যরা আস্থার সঙ্গে নেতৃত্ব নির্বাচন করতে পারবে। একই সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়ার নিয়মকানুন আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী স্বচ্ছ ও সহজবোধ্য করতে হবে। ভারতের FICCI বা তুরস্কের TOBB–এর মতো চেম্বারগুলোতে নেতৃত্ব আসে পেশাদারদের মধ্য থেকে, যাদের কর্মদক্ষতা ও ট্র্যাক রেকর্ড গুরুত্ব পায়।
৩.৪ সেক্টরভিত্তিক কাউন্সিল ও কার্যকরী কমিটির পুনর্গঠন
বাংলাদেশে প্রায় সব সেক্টরেরই প্রতিনিধিত্ব এফবিসিসিআই–তে রয়েছে, কিন্তু তাদের কার্যকর অংশগ্রহণ সীমিত। একটি বিশ্বমানের চেম্বারের জন্য প্রয়োজন সেক্টরভিত্তিক কাউন্সিল—যেখানে প্রতিটি খাতের জন্য আলাদা ওয়ার্কিং গ্রুপ থাকবে (যেমন টেক্সটাইল, আইসিটি, ফার্মা, কৃষি-প্রসেসিং, স্টার্টআপ, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি)। এরা গবেষণা, নীতি–প্রস্তাবনা ও প্রকল্প বাস্তবায়নে সরাসরি কাজ করবে। একই সঙ্গে কার্যকরী কমিটি গড়ে তুলতে হবে যেগুলো KPI (Key Performance Indicator) ভিত্তিক ফলাফল প্রকাশ করবে। এতে এফবিসিসিআইয়ের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, সেক্টরভিত্তিক বিশেষায়ন এবং জাতীয় নীতিতে প্রভাব বিস্তার—সবগুলোই আরও শক্তিশালী হবে।
৪. কৌশলগত অগ্রাধিকার
৪.১ রপ্তানি বাজার বৈচিত্র্যকরণ
বাংলাদেশের মোট রপ্তানির প্রায় ৮০ শতাংশ তৈরি পোশাক (RMG) খাতনির্ভর—যা একদিকে সাফল্যের প্রতীক হলেও অন্যদিকে ঝুঁকিরও উৎস। বৈশ্বিক চাহিদার পরিবর্তন, শুল্ক–অশুল্ক বাধা কিংবা কার্বন–সংশ্লিষ্ট বিধিনিষেধ (যেমন EU–এর CBAM) যদি আরোপিত হয়, তবে অর্থনীতি বড় আঘাত পেতে পারে। তাই প্রয়োজন বাজার ও পণ্যে বৈচিত্র্য। তথ্যপ্রযুক্তি (আইসিটি সেবা), ফার্মাসিউটিক্যালস, জুয়েলারি, কৃষিজাত প্রক্রিয়াজাত পণ্য, হালকা প্রকৌশল ও ব্লু–ইকোনমি খাতে নতুন রপ্তানি বাজার গড়ে তুলতে এফবিসিসিআই সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। Market intelligence unit, বিদেশে trade mission, এবং আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে সংগঠিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে এই বৈচিত্র্য আনা সম্ভব।
৪.২ এসএমই ও স্টার্টআপ উন্নয়ন
বাংলাদেশের ৯৯.৯% শিল্পই SME ও মাইক্রো উদ্যোগ; এরা প্রায় ২ কোটি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে এবং জিডিপিতে প্রায় ২১–২২% অবদান রাখে। কিন্তু তারা অর্থায়ন, প্রযুক্তি ও বাজার–অ্যাক্সেসে পিছিয়ে। একইভাবে স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমও এখনও নীতি ও বিনিয়োগের অভাবে সীমাবদ্ধ। একটি বিশ্বমানের এফবিসিসিআই SME Desk ও Startup Council গঠন করে উদ্ভাবনী পণ্য উন্নয়ন, বিনিয়োগ–সংযোগ, নেটওয়ার্কিং ইভেন্ট এবং আন্তর্জাতিক এক্সিলারেটর প্রোগ্রামে অংশগ্রহণে সহায়তা করতে পারে। এর ফলে তরুণ উদ্যোক্তা ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্যও নতুন দিগন্ত খুলে যাবে।
৪.৩ ডিজিটাল বাণিজ্য ও ই-কমার্স
বিশ্বব্যাপী ই-কমার্সের বাজার ২০২৪ সালে ৬ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশেও ই-কমার্স ও ডিজিটাল সেবার দ্রুত বৃদ্ধি লক্ষ করা যাচ্ছে। এফবিসিসিআই যদি ডিজিটাল ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে, তবে সদস্যরা আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেসে সহজে প্রবেশ করতে পারবেন। Paperless trade, e-certificate of origin, ডিজিটাল কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স, অনলাইন B2B ম্যাচমেকিং, এমনকি ব্লকচেইন–ভিত্তিক ট্রেড ডকুমেন্টেশনের মতো উদ্যোগ গ্লোবাল ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশকে এগিয়ে নেবে।
৪.৪ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক চেম্বার নেটওয়ার্কে সক্রিয় সম্পৃক্ততা
এফবিসিসিআই বর্তমানে অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্য হলেও এর কার্যকর সম্পৃক্ততা সীমিত। একটি বিশ্বমানের ফেডারেশন চেম্বারকে ICC, WCF, RCEP Business Council, BIMSTEC Chamber Forum, SAARC Chamber, এবং World Economic Forum–এর মতো নেটওয়ার্কে দৃশ্যমান ও প্রভাবশালী হতে হবে। এতে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা আন্তর্জাতিক নীতি আলোচনায় সরাসরি অংশগ্রহণ, গ্লোবাল ক্রেতা–সরবরাহকারীর সঙ্গে সংযোগ, এবং যৌথ প্রকল্প/বিনিয়োগ চুক্তি করতে পারবেন। আঞ্চলিক ব্লক যেমন RCEP, ASEAN, AfCFTA–এর সাথে অংশীদারিত্বও বাংলাদেশের বাণিজ্য বৈচিত্র্য ও নীতি–উপস্থিতি আরও শক্তিশালী করবে।
৫. সদস্যসেবা ও ব্যবসায়িক ইকোসিস্টেমে অবদান
৫.১ সদস্যদের সক্ষমতা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ
একটি বিশ্বমানের ফেডারেশন চেম্বারের মূল শক্তি হলো এর সদস্যরা। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ সদস্য–সংগঠন এখনও আধুনিক ব্যবসায়িক কৌশল, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য আইন, ডিজিটাল মার্কেটিং, মান নিয়ন্ত্রণ ও সবুজ উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিষয়ে পিছিয়ে আছে। এফবিসিসিআই যদি নিয়মিতভাবে সেক্টর–ভিত্তিক ট্রেনিং প্রোগ্রাম, এক্সিকিউটিভ কোর্স, ই-লার্নিং মডিউল এবং আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে ওয়ার্কশপ আয়োজন করে, তবে সদস্যদের দক্ষতা বাড়বে। পাশাপাশি, নারী উদ্যোক্তা ও তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করলে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি সম্ভব হবে।
৫.২ বিনিয়োগ আকর্ষণ ও বিদেশি ব্যবসায়িক সম্পর্ক সম্প্রসারণ
বাংলাদেশে ২০২৪ সালে নেট এফডিআই মাত্র ১.২৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এসেছে, যা কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধির তুলনায় অনেক কম। এফবিসিসিআই বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হয়ে উঠতে পারে। Investor Facilitation Desk, আন্তর্জাতিক রোডশো, সেক্টর–ভিত্তিক বিনিয়োগ গাইডলাইন প্রকাশ এবং বিদেশি দূতাবাস ও বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে যৌথ মঞ্চ গড়ে তুললে বিনিয়োগ প্রবাহ বাড়ানো সম্ভব। একই সঙ্গে diaspora investors–দের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন ও anchor investors আকর্ষণের কৌশল এফবিসিসিআইয়ের নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হওয়া উচিত।
৫.৩ বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তি ও আইনি সহায়তা
ব্যবসার ক্ষেত্রে লেনদেন–সংক্রান্ত বিরোধ একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। আদালতের মাধ্যমে এসব সমাধান হতে সময় ও খরচ দুটোই বেশি লাগে। তাই এফবিসিসিআইয়ের অধীনে একটি Alternative Dispute Resolution (ADR) সেল, আরবিট্রেশন ও মেডিয়েশন সেন্টার থাকা জরুরি। এতে সদস্যরা দ্রুত, কম খরচে এবং আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারবেন। পাশাপাশি বাণিজ্য আইন, ট্যাক্সেশন, কাস্টমস ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য চুক্তি বিষয়ে লিগ্যাল অ্যাডভাইসারি সার্ভিস থাকলে সদস্যদের ব্যবসায়িক ঝুঁকি অনেক কমে যাবে।
৫.৪ উদ্ভাবনী প্ল্যাটফর্ম: প্রদর্শনী, ডেলিগেশন ও গ্লোবাল ফোরামে অংশগ্রহণ
বিশ্বমানের ফেডারেশন চেম্বার কেবল ঘরোয়া পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং উদ্যোক্তাদেরকে গ্লোবাল ভ্যালু চেইনে সংযুক্ত করতে সেতুবন্ধন তৈরি করে। এজন্য আন্তর্জাতিক ট্রেড ফেয়ার, এক্সপো, ইনভেস্টমেন্ট সামিট, ক্রেতা–বিক্রেতা মিলনমেলা এবং উচ্চপর্যায়ের বিজনেস ডেলিগেশন আয়োজন করা প্রয়োজন। পাশাপাশি, WTO, WEF, ICC, WCF প্রভৃতি গ্লোবাল ফোরামে এফবিসিসিআইয়ের সক্রিয় অংশগ্রহণ ব্যবসায়ী সমাজকে আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত–প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করবে। এর ফলে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী নেতারা সরাসরি বিদেশি ক্রেতা, বিনিয়োগকারী ও নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবেন, যা দীর্ঘমেয়াদে রপ্তানি ও বিনিয়োগ বাড়াবে।
৬. নীতি-প্রস্তাবনা ও এডভোকেসি
৬.১ সরকার–বেসরকারি খাতের নীতি সংলাপ
লক্ষ্য: প্রমাণ–ভিত্তিক, সময়বন্ধ নীতি–সংলাপকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া, যাতে সিদ্ধান্ত দ্রুত হয় এবং বাস্তবায়ন মাপা যায়।
কীভাবে:
PPD Calendar & Taskforce: ত্রৈমাসিকভাবে Public–Private Dialogue (PPD) সূচি; প্রতিটি অগ্রাধিকার খাতে (টেক্সটাইল, আইসিটি, ফার্মা, এগ্রো, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি) যৌথ Govt–Industry Taskforce।
Policy Lab & RIA: এফবিসিসিআই–তে Policy Lab গঠন; প্রতিটি প্রস্তাবে Regulatory Impact Assessment (RIA), cost–benefit ও SME test বাধ্যতামূলক।
Commitment Tracker: মন্ত্রক–ভিত্তিক অ্যাকশন–পয়েন্ট অনলাইন ড্যাশবোর্ড (৩০–৬০–৯০ দিন ট্র্যাকার), মিটিং মিনিটস ও দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থার SLA প্রকাশ।
Stakeholder Map: মন্ত্রণালয়, নিয়ন্ত্রক, উন্নয়ন–অংশীদার ও উন্নয়ন ব্যাংকের সাথে single window of engagement।
KPI: গ্রহণকৃত প্রস্তাবের হার (%), নীতি–সিদ্ধান্তে গড় সময় (দিন), কার্যকর হওয়া সংস্কারের সংখ্যা, সদস্য–সন্তুষ্টি স্কোর।
৬.২ বাজেট, ট্যারিফ ও রেগুলেটরি বিষয়ে কার্যকর লবিং
লক্ষ্য: বাজেট–চক্রকে ডেটা–চালিত করা; ট্যারিফ/রেগুলেটরি জটিলতা কমানো ও বৈচিত্র্য–বান্ধব কাঠামো গড়া।
কীভাবে: Pre-Budget Evidence: খাতভিত্তিক সার্ভে, microsimulation (VAT/SD/AIT–AT প্রস্তাবের রাজস্ব ও বিনিয়োগ–প্রভাব), SME–focused tax simplification।
Tariff Matrix (HS-8): কাঁচামাল–মধ্যবর্তী–চূড়ান্ত পণ্যের effective rate of protection বিশ্লেষণ; রপ্তানি–ইনটেনসিভ ও উদীয়মান খাতে শুল্ক–পুনর্বিন্যাস।
NTM & Guillotine: অশুল্ক বাধা (NTM) অডিট; regulatory guillotine (অকার্যকর/ডুপ্লিকেট বিধান অপসারণ) ও one-in-one-out নীতি।
Trade Facilitation: bonded warehouse সম্প্রসারণ (নন-RMG), AEO প্রোগ্রাম, রিস্ক–ম্যানেজমেন্ট, ই–সার্টিফিকেট অব অরিজিন।
Green Incentives: জ্বালানি দক্ষতা, নেট-জিরো বিনিয়োগের জন্য accelerated depreciation/green credit; রপ্তানিতে ESG–কমপ্লায়েন্স রিবেট।
KPI: অর্থ আইন/এসআরও-তে গৃহীত ধারা (সংখ্যা), শুল্ক–লাইনে সমন্বয় (সংখ্যা), কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স সময় (ঘণ্টা), কমপ্লায়েন্স খরচের হ্রাস (%), NTM অপসারণ (সংখ্যা)।
৬.৩ শিল্পনীতি, বিনিয়োগনীতি ও বৈদেশিক বাণিজ্য নীতিতে অবদান
লক্ষ্য: উৎপাদন–ভিত্তি প্রসার, প্রযুক্তি–আপগ্রেড ও বাজার–অ্যাক্সেসে কাঠামোগত জাম্প।
কীভাবে (শিল্পনীতি):
Cluster & Supplier Development: জেলা–কেন্দ্রিক ক্লাস্টার, local supplier development (অ্যাঙ্কর–ইনভেস্টরের সাথে ভেন্ডর-আপগ্রেড)।
Tech Upgradation Fund: যন্ত্রপাতি আধুনিকায়ন, অটোমেশন, মান–সনদ (ISO/FDA/HACCP)–এ সহায়তা।
Quality Infrastructure: BSTI/ল্যাবের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি (MRA), টেস্টিং–সার্টিফিকেশন সক্ষমতা।
কীভাবে (বিনিয়োগনীতি):
Investor Aftercare & Ombudsman: aftercare সেল, বিনিয়োগ–অম্বুডসম্যান; OSS/NSW কর্মদক্ষতা KPI।
Performance-based Incentives: কর্মসংস্থান, রপ্তানি, লোকাল–কন্টেন্ট ও সবুজ মানদণ্ডে ফল–ভিত্তিক প্রণোদনা।
কীভাবে (বাণিজ্যনীতি):
FTA/PTA Readiness: CGE/partial equilibrium মডেলিং, rules of origin কৌশল, সেবা বাণিজ্য ও ডিজিটাল ট্রেড অধ্যায়।
Trade Facilitation 2.0: ন্যাশনাল সিঙ্গেল উইন্ডো পূর্ণতর, mutual recognition চুক্তি, সীমান্ত–লজিস্টিকস করিডোর।
Deliverables: Industrial Playbooks (ইলেকট্রনিক্স, ফার্মা, এগ্রো, লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং), FDI Aftercare Manual, FTA Position Notes, Export Diversification Roadmap।
KPI: FDI ইনফ্লো (বিলিয়ন $), রপ্তানি–ঘনত্ব সূচক (HHI) হ্রাস, নতুন বাজার/পণ্য সংখ্যা, স্বীকৃত ল্যাব/MRA সংখ্যা, OSS/NSW সেবার TAT।
৬.৪ বৈশ্বিক ইস্যুতে বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা
লক্ষ্য: এলডিসি–গ্র্যাজুয়েশন, কার্বন–রেজিম, সাপ্লাই–চেইন রি–অর্ডার প্রভৃতি ইস্যুতে proactive জাতীয় অবস্থান নিশ্চিত করা।
কীভাবে:
LDC Transition Playbook: preference erosion শক কমাতে GSP+/FTA ট্রানজিশন পরিকল্পনা, TRIPS–ফ্লেক্সিবিলিটি ও রুলস–অফ–অরিজিন শিথিলতা বিষয়ে অবস্থান।
CBAM/ESG Response: খাতভিত্তিক MRV (measurement–reporting–verification), কার্বন–ফুটপ্রিন্ট benchmark, সবুজ জ্বালানি–সুইচের ফাইন্যান্সিং (Aid-for-Trade 2.0/Green Facility)।
Due Diligence & Human Rights: সাপ্লাই–চেইন ডিউ–ডিলিজেন্স (traceability), জোরপূর্বক শ্রম রোধে সার্টিফিকেশন/অডিট প্রটোকল।
Global Forums & Coalitions: WTO/UNCTAD/WEF/ICC প্ল্যাটফর্মে Bangladesh Business Position Papers; LDC/SIDS/এশীয় কোয়ালিশনের সাথে যৌথ প্রস্তাব।
Resilience & Logistics: friend-shoring/near-shoring কৌশল, খাদ্য–এনার্জি–শিপিং ঝুঁকিতে কন্টিনজেন্সি–প্ল্যানিং।
KPI: আন্তর্জাতিক ঘোষণায় বাংলাদেশের প্রস্তাবের রেফারেন্স (সংখ্যা), রুল–ফ্লেক্সিবিলিটি/ট্রানজিশন এক্সটেনশন প্রাপ্তি, সম্মতি–ব্যয় হ্রাস (%), সবুজ সার্টিফিকেশনপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান সংখ্যা, মবিলাইজড ক্লাইমেট/ট্রেড ফাইন্যান্স (মিলিয়ন $)।
৭. দীর্ঘমেয়াদি ভিশন ও টেকসই উন্নয়ন
৭.১ ভিশন ২০৪১ এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিকল্পনা
বাংলাদেশের লক্ষ্য হলো ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত অর্থনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। এফবিসিসিআইকে সেই ভিশনের সাথে কৌশলগতভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে। এজন্য শিল্পখাতের আধুনিকায়ন, রপ্তানি বৈচিত্র্য, বিনিয়োগ প্রবাহ বৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও উদ্ভাবন–নির্ভর অর্থনীতির ভিত্তি গড়ে তোলাই প্রধান লক্ষ্য। এফবিসিসিআই যদি সরকারকে নিয়মিত রোডম্যাপ, সেক্টর–ভিত্তিক প্ল্যান ও বাস্তবায়ন মূল্যায়ন প্রতিবেদন সরবরাহ করে, তবে ভিশন ২০৪১ অর্জনে বেসরকারি খাতের অবদান স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান হবে।
৭.২ এসডিজি ও সবুজ শিল্পায়ন
জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি অর্জন (২০৩০) বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। শিল্প খাতে টেকসই উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু করা, পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও কার্বন ফুটপ্রিন্ট হ্রাস—এসব বিষয় ব্যবসায়িক খাতকে সরাসরি ছুঁয়ে যায়। এফবিসিসিআইয়ের উচিত একটি “Green Business Council” গঠন করা, যেখানে উদ্যোক্তাদের সবুজ বিনিয়োগে সহায়তা, কার্বন রিপোর্টিং, ESG (Environmental, Social, Governance) কমপ্লায়েন্সে গাইডলাইন প্রদান করা হবে। এর ফলে বাংলাদেশ শুধু রপ্তানি বাজার টিকিয়ে রাখবে না, বরং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাবে।
৭.৩ নারী ও যুব উদ্যোক্তা উন্নয়ন
বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তরুণ, আর নারীরা মোট জনশক্তির অর্ধেকেরও বেশি। অথচ এদের উদ্যোক্তা হিসেবে অংশগ্রহণ এখনও সীমিত। এফবিসিসিআই যদি নারী ও যুব উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ ইনকিউবেশন সেন্টার, সহজ অর্থায়ন, প্রশিক্ষণ ও মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম চালু করে, তবে তারা জাতীয় অর্থনীতির মূলধারায় আরও শক্তভাবে যুক্ত হবে। আন্তর্জাতিক উদাহরণ দেখায় যে, নারীনেতৃত্বাধীন ও তরুণ–উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলোই ভবিষ্যতের শিল্পে পরিবর্তনের চালিকাশক্তি।
৭.৪ জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির পথে চেম্বারের ভূমিকা
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে অর্থনীতি জ্ঞান, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তি–নির্ভর। বাংলাদেশে আইসিটি সেক্টর ইতোমধ্যেই রপ্তানিতে ১.৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করছে, তবে সম্ভাবনা এর চেয়েও অনেক বেশি। এফবিসিসিআইকে রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন উইং গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারি খাতকে সংযুক্ত করতে হবে। একইসঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ব্লকচেইন, বায়োটেকনোলজি ও ন্যানোটেকনোলজির মতো উদীয়মান খাতে উদ্যোক্তা তৈরি করা জরুরি। এভাবে এফবিসিসিআই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধাপে ধাপে একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপান্তরের নেতৃত্ব দিতে পারবে।
উপসংহার
বিশ্বমানের ফেডারেশন চেম্বার গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার অর্থনীতিকে আরও বৈচিত্র্যময়, প্রতিযোগিতামূলক ও টেকসই করে তুলতে পারবে। বর্তমানে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে অতিনির্ভরতা, কম এফডিআই প্রবাহ এবং প্রযুক্তিগত পিছিয়ে পড়া—এসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে হলে এফবিসিসিআইকে একটি আধুনিক নীতি–উকিলি প্ল্যাটফর্ম, গবেষণা–থিঙ্ক ট্যাঙ্ক, ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন হাব এবং গ্লোবাল কানেক্টর–এ পরিণত হতে হবে। এর মাধ্যমে রপ্তানি বাজার বৈচিত্র্য, নতুন খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণ, সবুজ শিল্পায়ন এবং আঞ্চলিক–বৈশ্বিক বাণিজ্য নেটওয়ার্কে সক্রিয় অংশগ্রহণ সম্ভব হবে। এ ধরনের রূপান্তর কেবল উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতামূলক ক্ষমতা বাড়াবে না, বরং বাংলাদেশকে বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত করবে।
তবে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য দরকার একটি কার্যকরী, ঐক্যবদ্ধ ও আধুনিক এফবিসিসিআই। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসনকে ভিত্তি করে, পেশাদার সচিবালয় ও প্রযুক্তিনির্ভর প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার আধুনিকায়ন, সেক্টরভিত্তিক কাউন্সিলের সক্রিয় ভূমিকা এবং নারী ও যুব উদ্যোক্তাদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করলে এফবিসিসিআই সত্যিকার অর্থে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠবে। এখন সময় এসেছে ব্যবসায়ী সমাজ একসঙ্গে এগিয়ে এসে এফবিসিসিআইকে এমন এক প্ল্যাটফর্মে রূপান্তর করার—যা শুধু বাংলাদেশের বাণিজ্য ও বিনিয়োগের স্বার্থ রক্ষা করবে না, বরং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বাংলাদেশের শক্তিশালী উপস্থিতি ও প্রভাব নিশ্চিত করবে।