প্রধান বানিজ্য সংগঠন এফবিসিসিআই আজ কার হাতে?

প্রধান বানিজ্য সংগঠন এফবিসিসিআই আজ কার হাতে?

 

মো: জয়নাল আব্দীন

প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নিবার্হী কর্মকর্তা, ট্রেড এণ্ড ইনভেস্টমেন্ট বাংলাদেশ (টিএণ্ডআইবি)

নির্বাহী পরিচালক, অনলাইন ট্রেনিং একাডেমি (ওটিএ)

মহাসচিব, ব্রাজিল বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স এণ্ড ইন্ড্রাস্ট্রি (বিবিসিসিআই)

 

 

বাংলাদেশের অর্থনীতি ও বাণিজ্যিক অঙ্গনে ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বারস অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) এক ঐতিহাসিক ও অগ্রণী প্রতিষ্ঠান। দেশের প্রধানতম ব্যবসায়ী সংগঠন হিসেবে এফবিসিসিআই দীর্ঘদিন ধরে সরকারের নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে আসছে।

 

স্বাধীনতার পর থেকে শিল্প, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, রপ্তানি–আমদানি এবং অর্থনৈতিক সংস্কার বিষয়ে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ী সমাজের সেতুবন্ধন রচনায় এই সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নীতি সহায়তা, অর্থনৈতিক সংস্কারের দাবি, বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং উদ্যোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় এফবিসিসিআইকে দেশের ব্যবসায়ী সমাজের প্রধান কণ্ঠস্বর হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়ে আসছে।

এক কথায়, এফবিসিসিআই শুধু একটি বাণিজ্য সংগঠন নয়, বরং বেসরকারি খাতের সম্মিলিত শক্তির প্রতীক যার প্রভাব সরাসরি দেশের অর্থনৈতিক গতিপথে প্রতিফলিত হয়।

 

২. কমিটি শূন্যতার এক বছর

বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের প্রধানতম এই সংগঠনটি আজ এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এফবিসিসিআই-তে কার্যকরী কোনো নির্বাচিত কমিটি নেই। যে সংগঠনটি হাজারো উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীর প্রতিনিধিত্ব করার কথা, সেখানে আজ নীতি নির্ধারণ ও নেতৃত্বের শূন্যতা প্রকট হয়ে উঠেছে।

 

সরকার প্রথমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য একজন প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছিল। প্রশাসকের দায়িত্ব ছিল সংগঠনের দৈনন্দিন কার্যক্রম সচল রাখা এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি কার্যকর নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। কিন্তু বাস্তবে সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। প্রশাসক মূলত সীমিত কার্যক্রম চালালেও উদ্যোক্তাদের জন্য কোনো দীর্ঘমেয়াদি দিকনির্দেশনা বা কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে সক্ষম হননি।

 

তারওপর, প্রশাসকের এক বছরের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর আর কোনো প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়নি। ফলে আজ এফবিসিসিআই কার্যত নিয়ন্ত্রণশূন্য অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। ব্যবসায়ী সমাজের কণ্ঠস্বর হবার পরিবর্তে প্রতিষ্ঠানটি যেন এক অনিশ্চয়তা ও নেতৃত্ব সংকটের মুখে পড়ে গেছে।

 

প্রধান বানিজ্য সংগঠন এফবিসিসিআই আজ কার হাতে?

৩. ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিনিধিত্বের সংকট

এফবিসিসিআই মূলত প্রকৃত উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের সংগঠন হওয়া সত্ত্বেও বর্তমানে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রায় অনুপস্থিত। যে প্ল্যাটফর্মটি ব্যবসায়ীদের নীতি নির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করার, স্বার্থ রক্ষার এবং দাবি-দাওয়ার ভাষ্য দেওয়ার কথা, সেটি আজ নেতৃত্বহীনতায় ভুগছে। এর ফলে উদ্যোক্তা সমাজের দাবি, অভিযোগ বা প্রস্তাবগুলো কার্যকরভাবে সরকারের নিকট পৌঁছাচ্ছে না।

 

সরকার ও প্রশাসনের কাছে ব্যবসায়ীদের কণ্ঠস্বর দুর্বল হয়ে পড়েছে। বেসরকারি খাতের সমস্যাগুলো যেমন করনীতি, আমদানি-রপ্তানি জটিলতা, বৈদেশিক বাজারে প্রতিযোগিতা কিংবা এসএমই খাতের সংকট এসব বিষয়ে এফবিসিসিআই থেকে কোনো শক্তিশালী অবস্থান বা প্রস্তাব আসছে না। এর প্রভাব সরাসরি পড়ছে ব্যবসায়ী সমাজের ওপর, যারা আজ নিজেদের প্রতিনিধিত্বহীন মনে করছেন।

 

ফলে দেশের নানা প্রান্তের গ্রাসরুটস ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোতে হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনগুলো মনে করছে, জাতীয় স্তরে তাদের কণ্ঠস্বর পৌঁছে দেওয়ার মতো কোনো কার্যকর ফোরাম নেই। এর ফলে উদ্যোক্তাদের আস্থা নষ্ট হচ্ছে এবং সংগঠনের প্রতি তাদের প্রত্যাশা ক্রমেই ক্ষীণ হয়ে আসছে।

 

৪. সরকারের ভূমিকা ও প্রশাসনিক বাস্তবতা

এফবিসিসিআই-এর দীর্ঘমেয়াদি অচলাবস্থা এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য সরকার একজন প্রশাসক নিয়োগ করেছিল। মূল উদ্দেশ্য ছিল সংগঠনের দৈনন্দিন কার্যক্রম সচল রাখা, স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনা এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে একটি কার্যকর নির্বাচন সম্পন্ন করা। সরকারের এই পদক্ষেপ ব্যবসায়ী সমাজের মধ্যে আশার সঞ্চার করলেও বাস্তবে প্রত্যাশিত ফলাফল আসেনি।

প্রশাসক দায়িত্ব পালনকালে কিছু নিয়মিত কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন বটে, তবে তার সীমাবদ্ধতা ছিল স্পষ্ট। কারণ, প্রশাসক নির্বাচিত প্রতিনিধি নন; তিনি ব্যবসায়ীদের সরাসরি ম্যান্ডেট পাননি। ফলে উদ্যোক্তাদের জোরালো দাবি উত্থাপন বা সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ী স্বার্থ নিয়ে কার্যকর আলোচনায় তিনি নেতৃত্ব দিতে পারেননি। তার কার্যক্রম মূলত আনুষ্ঠানিকতা রক্ষা ও নথিভুক্ত প্রক্রিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে।

 

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, প্রশাসকের এক বছরের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর আর কোনো প্রশাসক নিয়োগ করা হয়নি। এতে এফবিসিসিআই কার্যত এক ধরনের নিয়ন্ত্রণ শূন্য অবস্থায় পড়েছে। কোনো নেতৃত্ব নেই, সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতাও নেই। ফলে দেশের প্রধান বাণিজ্য সংগঠনটি আজ দিকহীন হয়ে পড়েছে, যা ব্যবসায়ী সমাজ এবং জাতীয় অর্থনীতির জন্য এক অস্বস্তিকর বাস্তবতা তৈরি করেছে।

 

 

৫. এফবিসিসিআই-এর ভবিষ্যৎ ঝুঁকি

এফবিসিসিআই দীর্ঘদিন ধরে সরকারের সঙ্গে নীতি নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় বেসরকারি খাতের স্বার্থ তুলে ধরার প্রধান প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু বর্তমানে নেতৃত্ব ও কাঠামোগত শূন্যতা থাকায় এই প্রভাব ক্রমেই কমে যাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক নীতি, কর ব্যবস্থা, আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া কিংবা শিল্পোন্নয়ন বিষয়ে ব্যবসায়ীদের অবস্থান স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। এর ফলে নীতিনির্ধারণের টেবিলে উদ্যোক্তা সমাজের উপস্থিতি দুর্বল হয়ে পড়ছে।

 

শুধু দেশীয় পর্যায়েই নয়, এফবিসিসিআই সবসময় বৈদেশিক বাণিজ্য, কূটনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিদেশি বাণিজ্য মিশন, দ্বিপাক্ষিক ব্যবসায়িক ফোরাম কিংবা আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে এফবিসিসিআই ছিল বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের মুখপাত্র। কিন্তু বর্তমান স্থবিরতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করছে এবং সম্ভাব্য বাণিজ্যিক সুযোগ হাতছাড়া হচ্ছে।

 

ফলে দেশীয় উদ্যোক্তারা আজ আস্থাহীনতায় ভুগছেন। তারা মনে করছেন, এফবিসিসিআই আর তাদের স্বার্থ রক্ষার কার্যকর প্ল্যাটফর্ম নয়। এই আস্থাহীনতা দীর্ঘস্থায়ী হলে উদ্যোক্তারা সংগঠন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে, যা শুধু এফবিসিসিআই নয়, বরং সামগ্রিকভাবে বেসরকারি খাতের সংগঠিত শক্তিকে দুর্বল করে দেবে।

 

Rising US Tariffs and the Road Ahead for Bangladesh’s Export Earnings

Export Support Services of T&IB

৬. ব্যবসায়ীদের করণীয়

বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন উদ্যোক্তা সমাজের ঐক্যবদ্ধ হওয়া। ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের বৃহত্তর বাণিজ্যিক স্বার্থে সবাইকে এক প্ল্যাটফর্মে আসতে হবে। এফবিসিসিআই কেবলমাত্র তখনই কার্যকর হবে, যখন এটি সমগ্র ব্যবসায়ী সমাজের ঐক্যবদ্ধ কণ্ঠস্বর হিসেবে দাঁড়াবে।

 

একইসঙ্গে জরুরি হলো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শক্তিশালী নেতৃত্ব নির্বাচন। একটি স্বচ্ছ, ন্যায্য এবং প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের মাধ্যমে এমন নেতৃত্ব আসতে হবে, যারা প্রকৃত উদ্যোক্তা সমাজের প্রতিনিধি হবেন এবং সরকারের সঙ্গে সমকক্ষ অবস্থানে থেকে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষা করবেন।

 

সবশেষে, এফবিসিসিআইকে আবারও প্রকৃত অর্থে বেসরকারি খাতের স্বার্থরক্ষার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি এবং নীতি নির্ধারণে সক্রিয় ভূমিকা রাখা। উদ্যোক্তা সমাজ যদি ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসে, তবে এফবিসিসিআই পুনরায় দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার শক্তিশালী চালিকাশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে।

 

৭. উপসংহার

সব আলোচনা শেষে মূল প্রশ্নটি আবার সামনে আসে প্রধান বানিজ্য সংগঠন এফবিসিসিআই আজ কার হাতে?” দীর্ঘদিনের শূন্যতা, নেতৃত্বহীনতা এবং কার্যক্রমের অচলাবস্থা দেশের বেসরকারি খাতের জন্য এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। যে সংগঠনটি ব্যবসায়ী সমাজের মুখপত্র হওয়ার কথা, সেটি আজ দিকহীন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।

 

এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাদের সচেতন হওয়া দৃঢ় অবস্থান নেওয়া। তারা যদি ঐক্যবদ্ধভাবে সংগঠনের পুনর্গঠন, স্বচ্ছ নির্বাচন এবং প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করেন, তবে এফবিসিসিআই আবারও তার ঐতিহ্য ও মর্যাদা ফিরে পাবে। অন্যথায় এই শূন্যতা কেবল সংগঠন নয়, বরং পুরো দেশের অর্থনীতির জন্যই ঝুঁকি হয়ে থাকবে।

0 replies

Leave a Reply

Want to join the discussion?
Feel free to contribute!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *